আপনি একটি সরকারি অফিসে দরখাস্ত দিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজে গিয়ে চিঠি খুঁজে দেখিয়ে দিলে তারপর সেটা ফাইলে ওঠে। প্রথমে আপনার চিঠি পাওয়াই যায় না। তারপর পাওয়া গেলেও ফাইল পাওয়া যায় না। লেগে থেকে কাজ করাতে হয়।
ছোটখাটো কাজে সিদ্ধান্তের জন্যও ফাইল ওপরে চলে যায়। ফলে কাজ শেষ হতে দেরি হওয়া স্বাভাবিক। একদিন হয়তো দেখলেন, ফাইল অনুমোদন হয়েছে, আদেশ জারি হবে– সেদিন অফিস সময় প্রায় শেষ। অতএব, পরদিন আবার যেতে হয়। এসব বিড়ম্বনা যাতে না আসে, সেই লক্ষ্যে ক্যাডার সার্ভিসের চাকরির শুরুতে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
আশির দশকের প্রথম দিকে পরিস্থিতি যতটা ইতিবাচক ছিল, নব্বই দশক থেকে সে চালচিত্র পাল্টে যেতে থাকে। প্রশিক্ষণ ক্লাসে নৈতিকতা, সততা আর সাহসের কথা বলার লোক ক্রমেই কমতে থাকে। পরের প্রজন্মের প্রশিক্ষক অনেকেই হয়তো জ্ঞান-গরিমায় আগের প্রশিক্ষকদের সমকক্ষ হতে পারেন; কিন্তু অন্য কিছু বিষয়ে আগের প্রশিক্ষকরা বেশি দৃষ্টি কাড়তে পেরেছেন।
আশির দশকের শেষ দিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তাঁবেদার এক শ্রেণির সিনিয়র কর্মকর্তার কারণে সরকারি সার্ভিসগুলো তার ঐতিহ্য হারাতে থাকে। বুক চিতিয়ে কথা বলার লোক কমতে শুরু করে। সাধারণত সরকারের সুনজরে না থাকলে নানাবিধ কারণে কাউকে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে গেস্ট স্পিকার হিসেবে না ডাকার রেওয়াজ শুরু হয়। যাদের ডাকা হয়, তাদের মধ্যে দলের প্রতি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আনুগত্য দেখানো কর্মকর্তাদের আধিক্য দেখে প্রশিক্ষণার্থীদের শ্রদ্ধায় ফাটল ধরে। ফলে তারা আগের মতো ভালো ভালো কথা বুকের মধ্যে লালন করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনুপ্রেরণার অভাবে প্রশিক্ষণের ফসল থেকে বীজতলা সংগ্রহে ভাটা পড়ে।
প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রজ্ঞা এবং বাস্তব শিক্ষার জন্য মোক্ষম সুযোগ রয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতার স্থান– যার যার চাকরির প্রতিষ্ঠানে। জীবনব্যাপী এই দক্ষতা অর্জনের কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজ, সঠিক কাজ, ন্যায় কাজ করার প্রেরণা দেওয়ার লোক থাকে। কিন্তু তার সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় নবীন কর্মকর্তারা প্রেরণা পাওয়ার মতো শিক্ষাগুরু হারাতে থাকেন। ভয়ানক দলীয়করণের কারণে রাজনৈতিক লবিং ছাড়া সিনিয়র অফিসার জুনিয়রের কোনো উপকার করতে পারেন না। জুনিয়র কোনো ঝামেলায় পড়লে তাঁকে তা অন্য উপায়ে মোকাবিলা করতে হয়। ভালো পদায়ন বা পদোন্নতি অফিসের সুপারভাইজারের মাধ্যমে হয় না। ফলে কর্মক্ষেত্র চাকুরেদের জীবনে গুরুত্ব হারাতে থাকে।
চাটুকারিতা এবং অনৈতিক লবিং করে অনেকেই পিরামিডের চূড়ায় উঠে যান। এখানে নেতৃত্ব, কর্মদক্ষতা, পারঙ্গমতা ছাড়া অন্য বিবেচনা প্রাধান্য পায়। ‘এই লোক অতীতে এই ছাত্র রাজনীতি করেছে; এই লোক দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা বা নেত্রীর আত্মীয়। অতএব সে বিশ্বস্ত এবং তাকে বড় দায়িত্ব দাও।’ ফলে এমন এমন লোক দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় বড় বড় পদে চলে গেছেন, যাদের নিজ পারফরম্যান্স কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। তাদের কাছ থেকে আগের মতো ভালো কিছু শেখার ঐতিহ্য বিলীন হয়েছে। এভাবে ওপরের প্রতি শ্রদ্ধার স্থান হারানো, আর নিচের প্রতি ওপরের সন্দেহ (কে কোন গ্রুপের লোক) সৃষ্টি হওয়ায় টিমের সঙ্গে সবাই সম্পৃক্ত হতে পারেন না।
‘দশে মিলে করি কাজ’-এর ধারণা অধরাই রয়ে যায়। শ্রদ্ধার চেয়ে ভয়ের সংস্কৃতির ওপর সিনিয়র-জুনিয়রের সম্পর্ককে দাঁড়াতে হয়। পরামর্শ, নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রদ্ধার আদান-প্রদানের সুতো ছিন্ন হওয়ায় নিবেদিত হয়ে কাজ করার প্রেরণা শিথিল হয়ে য়ায়। অফিস-আদালত থেকে তাই জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা, ভালো ব্যবহার এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ পাবে, এমন আশা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে ।